
বেশ ভালোই দিনকাল কাটছে কামালের।প্রাইভেট একটা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পাশাপাশি বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার দেখাশুনা এখন তার উপরে।বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর একমাত্র ছোট বোনটারও বিয়ে হয়ে যায়। এখন পরিবারে শুধু কামাল আর মা।ছোট এই সংসারে কোন কিছুরই অভাব নেই, তবুও মা কেন জানি একটা অতৃপ্তিতে ভুগছেন। ছেলের কাছে মায়ের আবদার বাবা – তুই সারাদিন অফিস আর ব্যবসা নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে থাকিস। আমি যে বাড়িতে একেবারে একা পড়ে থাকি। আমার একদম ভালো লাগেনা। কিন্তু মা-সংসারে সুখের জন্যই তো আমার এসব কিছু। তা ঠিক বলছো বাবা – তবুও কেন জানি!…….
কামালের বুঝতে আর বাকী রইলো না,মা কিসের অতৃপ্তিতে ভুগছেন। মা তো,নিজের ছেলের কাছে এভাবে সরাসরি বলতেও লজ্জাবোধ করছেন। ছোট বোন বেড়াতে এসে মায়ের অতৃপ্তির কথা ভাইয়ের কাছে খুলে বলে।প্রথম দিকে রাজি না হলেও একমাত্র ছেলে হিসেবে মায়ের কথা বিবেচনা করে সম্মতি দেয় কামাল। সবার চাহিদা অনুযায়ী পাত্রী ও দেখে ঠিক করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে বিয়ের সব ধরণের আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। নতুন পুত্রবধূকে ঘরে এনে খুব খুশি মা।কলিজার টুকরা একমাত্র ছেলের পুত্রবধূকে নিয়ে সুখেরই দিন কাটছে মায়ের। এখন সবসময় মায়ের মুখে হাসি লেগেই আছে, তবে কেন জানি মায়ের এই হাসিটা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো! বিয়ের সব জামেলা শেষ করে পুনরায় ব্যবসা ও চাকুরীতে মনোনিবেশ করে কামাল।
আজ অনেকটা রাত করে ঘরে ফিরে কামাল। দরজায় নক করতেই অমনি খুলে যায়। অবাক হয় কামাল! এতরাত এখনো ঘুমাও নি মা?(‘ছেলে কি বুঝে কলিজার টুকরা সন্তানকে বাহিরে রেখে মায়ের ঘুম কি করে আসে!’) তুই আসতে দেরি হচ্ছিল তাই পুত্রবধূকে বললাম ঘুমিয়ে যেতে। মা পাশে বসে ছেলেকে খাবার খাওয়ালেন। খাবারদাবার শেষ করে ঘুমোতে যাবে এমন সময় মায়ের ডাক। সাথে সাথে চলে আসে কামাল। কি হয়েছে মা? ডাকলে যে, বাবা হঠাৎ করেই আমার পেটের বা দিকটায় ব্যথা করছে।অস্বস্তিতে এদিক সেদিক গড়াগড়ি করতে লাগলেন। পাশে থেকে সারারাত জেগে মায়ের সেবাযতœ করলেন পুত্র এবং পুত্রবধূ। কিন্তু ব্যথার মাত্রাটা আরো বাড়তে থাকে। খুব ভোরে মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে কামাল। সেখানে চলতে থাকে ডাক্তারি চিকিৎসা। মাঝে মাঝে ব্যথা কিছুটা কমলেও একেবার কমছেনা।মাকে নিয়ে একটি সপ্তাহ হাসপাতালে কেটে যায়। মায়ের অসুস্ততার জন্য এখন কিছুই ভালো লাগছেনা কামালের। এদিকে খাওয়া-দাওয়া ও একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন মা।শরীরের অবস্থাটা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে মায়ের।
বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তারের পরামর্শে মাকে নিয়ে বাড়িতে আসে কামাল।
প্রতিদিনের মতো আজকের রাতেও মায়ের সাথে গল্পগুজব করে খাবার গ্রহণ করে। ভোরবেলা যখন ডাকতে আসে কামাল, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই মায়ের। কি হয়েছে এই ভেবে যখন মায়ের শরীরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে তখনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কামাল। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মা।তবে কামাল কি জানতো আজকের রাতটাই মায়ের সাথে তার শেষ খাওয়া! মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই, কোন সময় কার ডাক পড়ে কে জানে? কান্নার শব্দে আশেপাশের অনেকেই ছুটে আসলেন। কিছু সময় পর মাইকিং করে জানানো হলো কামালের মায়ের মৃত্যুর সংবাদ। আত্মীয় স্বজন সবাই আসলেন। গ্রামের সবার সহযোগীতায় দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হলো। কাঁদতে কাঁদতে একেবারে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে কামাল। দুইজনের কাধের উপর ভর করে জানাজায় শরীক হয় কামাল। এদিকে বাড়িতে একমাত্র ছোট বোনটিও কাঁদতে কাঁদতে একেবারে পাগলপ্রায়। মায়ের দাফন সমাপন করে ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কামাল……
আজ মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে কামালের। মা হীনা ঘরটাকে এখন একেবারে শূন্য মনে হচ্ছে। মনটা খুব ভালো নেই তবুও ব্যবসায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করছে কামাল। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষে যখন ঘরে ফিরে, তখনি কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যায় কামালের। মা ছাড়া ঘরটাতে এখন আর কেউ গবীর রাত পর্যন্ত বসে বসে অপেক্ষা করে না।খাবারের তালা সামনে নিয়ে কেউ আর এখন বসে থাকে না। এক ডাকে এখন আর কেউ দরজা খুলে দেয়না। এসব ভাবতেই চোখ ভিজে অশ্রু পড়তে থাকে। মায়ের আদরমাখা। স্মৃতিগুলো আজ বড্ড অনুভব করছে কামাল।
