
।। আনিস আলমগীর ।।
একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এমন কোনো দিন নেই বিশ্ব মিডিয়ায় ট্রাম্প নেই। তার কারণ হয়তো গত প্রায় এক শতাব্দী চেষ্টার পর যে একটা বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ট্রাম্প সে

ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য একটার পর একটা উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। সারা বিশ্বকে উদ্বেগের মাঝে রেখেছেন তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই।
সর্বশেষ দ্বিতীয়বারের মতো জারি করেছেন ‘মুসলিম নিষিদ্ধকরণ’ আদেশ। এর আগে জারিকৃত প্রতিটি আদেশ স্বাক্ষরের আগে সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরা ডেকে আনা হয়েছিল, কিন্তু এবার সেই কাজটি তিনি সেরেছেন চুপিসারে। এমনকি নিজেও সে আদেশের কথা ঘোষণা করেননি। তার মন্ত্রিসভার তিন সদস্য সে দায়িত্ব পালন করেন। আগের বার ৭টি দেশ তালিকাভুক্ত থাকলেও এবার নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে ছয়টি দেশ ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন। ইরাকি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লবিংয়ের পর দেশটিকে নিষিদ্ধ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
গ্রিন কার্ডধারী ও যাদের ভিসা রয়েছে, এমন পর্যটকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে কোনো বাধা নেই বলেও জানানো হয়েছে। এসব দেশের সংখ্যালঘু অমুসলিমদের (মূলত খ্রিস্টানদের) অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে আসার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, বর্তমান আদেশে তা বাতিল করা হয়েছে। আদালত আটকে না দিলে ১৬ মার্চ মধ্য রাতের পর থেকে এই দ্বিতীয় আদেশ কার্যকর হওয়ার কথা। নতুন আদেশ নিয়ে আইনি বিপর্যয় এড়াতে পর্যাপ্ত সতর্কতা নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আইন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই আদেশটির বিরুদ্ধে মামলা হলে সরকারের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
২০০৯ সালে বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী মাসে তার জনপ্রিয়তার লেভেল ছিল ৭৬ শতাংশে আর ২০১৭ সালে ক্ষমতায় বসায় পরবর্তী মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার লেভেল হচ্ছে ৩৯ শতাংশ। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (অবসরে গেছেন) জুবাল আভিভ বলেছেন, ট্রাম্প আগামী ৪/৫ সপ্তাহের মাঝে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে পারেন। ইমপিচমেন্টের মূল কারণ হচ্ছে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
এ কথাটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তারা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আর তাদের সে কর্মকাণ্ডের সব রেকর্ড আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের হাতে মজুদ রয়েছে। এ কর্মকাণ্ডের রেশ ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল টি. ফ্লিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের চার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ট্রাম্প এরই মধ্যে এফবিআইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে একটা সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এফবিআই বিষয়টা দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দিয়েছে।
নির্বাচনের আগে রাশিয়া ট্রাম্পের দুর্বলতা বুঝে তাকে রাশিয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। বিশ্লেষকরা বিষয়টাকে নিক্সনের ওয়াটার গেইটের সঙ্গে তুলনা করে নাম দিয়েছেন রাশিয়া গেইট। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত রাশিয়া যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিগ্যান। রিগ্যানের ষড়যন্ত্রেই সোভিয়েতের পতন হয়েছিল। তখন রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিন ছিলেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির প্রধান। সুতরাং পুতিন সোভিয়েত পতনের সব দৃশ্যেরই রাজসাক্ষী। প্রতিশোধপ্রবণ হওয়া তো স্বাভাবিক।
বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলোর কারো সঙ্গে ট্রাম্পের ভালো সম্পর্ক নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আমেরিকার বোঝা হিসেবে মনে করেন। এ বিষয়টা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর উদ্বেগের সীমা নেই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাঝে মাঝে রাশিয়ার সেনা বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হুংকার প্রদান করে থাকেন। মূলত এটা প্রচ্ছন্নভাবে ন্যাটোকেই হুমকি দেয়া। পুতিন উচ্চবিলাসী। তিনি চান সোভিয়েত ইউনিয়নের পুনরুত্থান। এর মাঝে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া দ্বীপ দখল করেও নিয়েছেন। রাশিয়া দাবি করে ইউক্রেন তাদেরই অংশ। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের উপকূলের অংশের লোকজন রাশিয়ার বংশোদ্ভূত। তাদের সঙ্গে ইউক্রেনের লোকজনের গোলযোগ লেগেই আছে। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ আর ইউক্রেন তো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯০ সালে তারা সোভিয়েত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের যে কোনো আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করার জন্যই গত শতাব্দীর পাঁচ-এর দশকে ন্যাটোর জন্ম। ন্যাটোর সদস্যদের মাঝে আমেরিকাই হচ্ছে সর্ববৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র। রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হলে আমেরিকার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, তারা ইউরোপের পাহারাদারী আর করবেন না। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উদার ভূমিকার কারণে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো পুনঃগঠিত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল। স্টালিনের ‘দুর্বৃত্তায়ন’ থেকে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে রক্ষার জন্য আমেরিকা ন্যাটো গঠন করে মজবুত সুরক্ষার ব্যবস্থাও তৈরি করেছিল।
১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ছিল পশ্চিম ইউরোপের জন্য উদারতার বাতিঘর। সেদিন আমেরিকা অনুরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ না হলে স্টালিন পশ্চিম ইউরোপকে লণ্ডভণ্ড করে দিতেন। ন্যাটোর অস্তিত্ব না থাকলে কিউবাসহ ল্যাটিনে সোভিয়েত রাশিয়ার বহু স্যাটেলাইট রাষ্ট্রের জন্ম হতো। আমেরিকার গত শতাব্দীর চার-পাঁচ দশকের রাষ্ট্র নায়করা অহেতুক সব কাজ করেনি। তাদের কাজের পেছনে সুদূরপ্রসারি প্রতিক্রিয়া ছিল।
আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। সম্ভবত এ কথাটা তার উপলব্ধিতে এসেছে। তাই দেখা যাচ্ছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি স্টেট অব দি ইউনিয়নের ভাষণ প্রদানের সময় কংগ্রেসের যৌথ সভায় মডারেইট সুরে কথাবার্তা বলেছেন তিনি। তবু তিনি আমেকিরার ভূমিকাকে ঘরমুখী রেখে বলেছেন, পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করা আমার দায়িত্ব নয় আমার দায়িত্ব হচ্ছে আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করা। পুতিনের সঙ্গে নির্বাচনের সময় তার গোপন যোগাযোগের বিষয়টা তাকে তাড়া করে ফিরলেও ট্রাম্প কারো নাম উল্লেখ না করেও ভাষণে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে নতুন করে আঁতাত গড়ে তোলার অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্প ইসলামিক মৌলবাদী সন্ত্রাসকে নির্মূল করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এ ভাষণ মুখোশ পরা ভাষণ, ক্ষণিকের ভালো কথা। আসলে ট্রাম্প সংবিধানের সঙ্গে যে ক্লেশ তৈরি করেছেন তাই অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবেন এবং এ সংঘাত আমেরিকাকে এক অচেনা সংঘাতে ফেলে দেবে। নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যম। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানকে নিরলসভাবে আক্রমণ করে চলছেন যেন প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
ট্রাম্প বিশ্ব ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। ফ্রান্সে ৭ মে যদি দক্ষিণপন্থি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দ্বিতীয় পর্যায়ে জিতে আসেন তবে ট্রাম্পের আরেক দোসর মিলবে ইউরোপে। উগ্র ডানপন্থি ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রার্থী মেরিন লি পেন নির্বাচিত হলে ফ্রান্স ইউরো জোন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবে। এতে ফ্রান্স নিজে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলো মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়বে। তবে তিনি যদি হেরে যান তবে ইউরোপে সাময়িকভাবে হলেও জাতীয়তাবাদী ঢেউ ভেঙে যাবে এবং বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পাবে। ফ্রান্সে যদি মেরিন লি পেন আসতে পারে তবে বিশ্বব্যবস্থা খারাপ রূপ ধারণ করবে। বিশ্বব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে, বিশ্বের উন্নয়নই বাধাগ্রস্ত হবে। তখন বিশ্ব শান্তিও ধীরে ধীরে বিনষ্ট হবে।
হয়তোবা এ সমস্ত অশুভ গ্রাস থেকে যদি অচিরেই মুক্ত হওয়া না যায় তখন বিশ্বকে তার নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য ভিন্ন শক্তির আশ্রয়ে যেতে হবে। কোনো না কোনো শক্তিশালী দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ ছাড়া বিশ্ব ব্যবস্থা সচল থাকতে পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
– ঢাকার দৈনিক মানবকণ্ঠের সৌজন্যে
