
আহমেদ মূসা
বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এক কথাশিল্পী অতীন বন্দোপাধ্যায় গত ১৮ জানুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন । এই অমর কথাশিল্পীর জন্ম ১৯৩০ সালে, নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার রাইনাদি গ্রামে। তাঁর জন্মস্থানের খুব কাছেই রয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পূর্ব-পুরুষের আদিভিটা বারদী। অবশ্য

বারদী পড়েছে সোনার গাঁ-তে।
অতীন বন্দোপাধ্যায়ের মহৎ সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘ঝিনুকের নৌকা’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি, ‘পঞ্চযোগিনী’ প্রভৃতি।
আমার জন্মস্থানও আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের ইজারকান্দী গ্রামে। দূরত্ব খুব বেশি নয়। ঢাকা থেকে থানা সদর হয়ে গ্রামের বাড়িতে গেলে রাইনাদির পাশ দিয়ে যেতে হয়। নিজের অজান্তেই তখন একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাংলা-ভাগ কত প্রতিভাবান মানুষকেই না আমাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
অতীন জন্মভূমি ছেড়ে কেন, কীভাবে গেলেন এবং ভারতে গিয়ে কী ভয়াবহ জীবন-সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়েছে, সেসব তাঁর লেখনীতেই রয়েছে। তাঁর পূর্ব-পুরুষ রূপগঞ্জে মুড়াপাড়ার জমিদারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। নিজেদেরও অনেক সহায়-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু অতীনরা রাতারাতি পরিণত হয়েছিলেন উন্মুল-উদ্বাস্তুতে। জাহাজের শ্রমিকের কাজ নিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অতীন শুরু করেন তাঁর জীবিকা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিযুক্ত থেকেও সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন।
সম্ভবত বছর ত্রিশেক আগে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় অতীন বন্দোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস পড়ে চমকে উঠেছিলাম। লেখার পটভূমি আড়াইহাজার, বৈদ্যরবাজার, বারদী, গোপালদী প্রভৃতি অঞ্চল। তারপর খুঁজে-খুঁজে তাঁর অন্যান্য লেখা পড়তে থাকি। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র মধ্যে আড়াইহাজারের প্রতিবেশ-পৃথিবী উঠে এসেছে মোহনীয় চিত্রকল্প নিয়ে। সেই ফাওসার বিল, জালালীর জীবন-সংগ্রাম, সমকালের দারিদ্র্য-দৈন্য, ভাগ্য-বিপর্যয় পাঠকদের অন্তরে গেথে থাকবে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল লেখককে তাঁর জন্মস্থানে এনে সম্বর্ধনা দেওয়ার। ২০০২ সালে আমি যখন সোনার গাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক, তখন একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার কার্যালয়ের সঙ্গেই একটি উন্নতমানের ডাকবাংলো। ভেবেছিলাম তিনি এলে এখানেই কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা করব। তাঁর পৈত্রিক ভিটাসহ গোটা এলাকা ঘুরিয়ে দেখাব। কিন্তু প্রথম দরকার লেখকের সম্মতি। লোকশিল্প জাদুঘরে পশ্চিম বাংলার দূরদর্শন (আকাশটিভিও হতে পারে) চ্যানেলের একজন সাংবাদিক প্রায়ই আসতেন। তার সঙ্গে অতীন বন্দোপাধ্যায়ের জানাশোনা আছে শুনে তাঁকেই অনুরোধ করলাম লেখকের সম্মতি আদায়ের। সম্মতি পেলে এলাকার বিশিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে বাকী কাজ সম্পন্ন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর সেই সাংবাদিক জানালেন, অতীন বন্দোপাধ্যায় আসতে পারবেন না। তাঁর নাকি পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা আছে। ভারতে পাসপোর্ট পাওয়া বা নবায়ন বেশ কঠিন জানতাম, কিন্তু অতীন বন্দোপাধ্যায়ের মতো এতো বড় লেখক এই সামান্য ব্যাপারে আটকে থাকবেন এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। জন্মভূমির সজীব চিত্রকল্পটা হয়তো বুকের মধ্যেই তাজা রাখতে চেয়েছেন। পিতৃ-ভিটার পরিবর্তনটা তার হয়তো দেখার ইচ্ছে ছিল না। সে কারণে বুকে কোদাল চালাতে চাননি। কিন্তু তাঁর কলম আমৃত্যু হাহাকার করে গেছে বাল্যকালে ফিরে।
আমার আরেকটা ইচ্ছে ছিল লেখকের সঙ্গে দেখা করার। ২০০৫ সালে আমি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কলিকাতা বইমেলায় যোগদান করি। ইচ্ছে ছিল মেলাশেষে দেখা করতে যাব। কিন্তু মেলা শেষ হওয়ার আগেই দুটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হই। এর একটি হচ্ছে মুখের বামপাশে ভয়ানক ভাইরাল ইনফেকশন এবং অন্যটি পেরিফেরিয়াল ভাসকুলার ডিজিজ- উপরের দিক থেকে পায়ে রক্ত চলাচল হ্রাসের কারণে হাঁটলে ব্যথা করা। তাই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেবার। পরবর্তীকালে পায়ের সমস্যার জন্য ঢাকা ও নিউইয়র্কে দুবার মেজর অপারেশন করতে হয়। ভাইরাল ইনফেকশনও আরেকটু উপরের দিকে উঠলে অচল হয়ে পড়তাম। সময়মতো চিকিৎসার জন্য রেহাই পাই। কিন্তু এগুলি একেবারে যায়নি। রেশ রয়ে গেছে বাম কান, বাম চোখ ও জিহবার বাম পাশে।
২০০৬ বাংলাভিশনের সাংবাদিক ও কারিগরি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লী থেকে ফেরার পথে অল্প সময়ের জন্য কলিকাতা গিয়েছিলাম। সেবারও জটিলতার কারণে যেতে পারিনি। কিন্তু একদিন অবশ্যই যাব বলে স্থির করে রেখেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপর একটি বিস্তারিত লেখার ইচ্ছেটা এখনো জারি আছে। আমার প্রিয় এই লেখকের স্মৃতির প্রতি রইলো বিন¤্র শ্রদ্ধা। কামনা করি তাঁর আত্মার চিরশান্তি।
নিউ ইয়র্ক, ২০ জানুয়ারি, ২০১৯।
– আহমেদ মূসা লেখক-সাংবাদিক-নাট্যকার। সাপ্তাহিক বর্ণমালার উপদেষ্টা সম্পাদক।
